এইচআইভি (HIV) বা হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস এমন একটি ভাইরাস যা মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে ধ্বংস করে। এটি মূলত দেহের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোকে আক্রমণ করে, বিশেষ করে CD4 কোষ বা টি-সেল। যদি এইচআইভি সংক্রমণ দীর্ঘ সময় চিকিৎসা ছাড়া থেকে যায়, তবে এটি এডস (AIDS) এ পরিণত হতে পারে, যা শরীরকে নানা সংক্রমণ এবং রোগের প্রতি অত্যন্ত দুর্বল করে তোলে। এইচআইভি আক্রান্তদের জন্য সঠিক সময়ে সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এইচআইভির কারণ
এইচআইভি মূলত সংক্রমিত রক্ত, বীর্য, যোনিপ্রদাহ, এবং মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি সাধারণত নিচের কিছু পদ্ধতিতে একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়:
- অরক্ষিত যৌনমিলন: সুরক্ষিত যৌনমিলন না করলে সংক্রমিত বীর্য, যোনিপ্রদাহ বা মলদ্বারের তরলের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়াতে পারে।
- সংক্রমিত সূঁচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার: বিশেষ করে মাদকাসক্তদের মধ্যে এটি সাধারণ।
- মা থেকে শিশুতে সংক্রমণ: গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় বা স্তন্যপানের মাধ্যমে সংক্রমিত মা থেকে শিশুর মধ্যে এইচআইভি ছড়াতে পারে।
- রক্ত সংক্রমণ: যদিও এখন অনেক দেশে রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থার কঠোর নিয়ম রয়েছে, তবুও সংক্রমিত রক্তের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে।
এইচআইভির সাধারণ উপসর্গ
এইচআইভি সংক্রমণের লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন স্পষ্ট নাও হতে পারে, তবে সংক্রমণের বিভিন্ন ধাপ অনুযায়ী উপসর্গগুলো ভিন্ন হতে পারে। এইচআইভির তিনটি প্রধান ধাপ রয়েছে: প্রাথমিক সংক্রমণ (অ্যাকিউট এইচআইভি), ক্লিনিক্যাল লেটেন্সি, এবং এডস।
১. প্রাথমিক সংক্রমণ (Acute HIV):
এইচআইভি সংক্রমণের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কিছু মানুষ ফ্লু-এর মতো লক্ষণ অনুভব করতে পারে, যা সাধারণত ২-৬ সপ্তাহ ধরে স্থায়ী হয়। এই লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:
- জ্বর
- মাথাব্যথা
- গলা ব্যথা
- লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
- শরীরে লালচে ফুসকুড়ি
- মাংসপেশিতে ব্যথা
- ক্লান্তি
২. ক্লিনিক্যাল লেটেন্সি (Latent Stage):
এই সময়ে ভাইরাসটি শরীরে সক্রিয় থাকে, কিন্তু লক্ষণগুলো প্রায়ই দেখা যায় না। এই পর্যায়টি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে (১০ বছর বা তার বেশি) এবং রোগী সাধারণত ভালো অনুভব করে। তবে, এই সময়ে ভাইরাস ধীরে ধীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে।
৩. এডস (AIDS):
যখন এইচআইভি সংক্রমণ এডস-এ পরিণত হয়, তখন শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত কমে যায়, এবং এই সময়ে রোগীর নানা ধরনের সংক্রমণ ও ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এডস-এর লক্ষণগুলো হলো:
- দ্রুত ওজন কমে যাওয়া
- বারবার জ্বর বা রাতের বেলা ঘামানো
- দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া
- দীর্ঘ সময় ধরে কাশি এবং শ্বাসকষ্ট
- লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া (৩ মাসের বেশি সময় ধরে)
- মুখ, গলা বা যোনিতে ঘা
- দুর্বলতা এবং ক্লান্তি
এইচআইভির জটিলতা
যদি এইচআইভি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে এডস-এ পরিণত হতে পারে। এডস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা নানা ধরনের অপপোরচুনিস্টিক ইনফেকশন-এ (opportunistic infection) আক্রান্ত হতে পারেন, যেমন:
- নিউমোনিয়া
- টিউবারকিউলোসিস (ক্ষয়রোগ)
- ক্যান্সারের নানা ধরন, যেমন কপোসি সারকোমা
- সিএনএস ইনফেকশন
এইচআইভির চিকিৎসা
এইচআইভির জন্য এখনো কোনো স্থায়ী নিরাময় নেই, তবে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (ART) নামক চিকিৎসা পদ্ধতি ভাইরাসের বৃদ্ধিকে দমন করতে পারে এবং রোগীকে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপন করতে সহায়তা করে।
১. অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (ART):
এইচআইভি চিকিৎসার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ সেবন করা।
- ART শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- এটি রোগীর সুস্থ জীবনযাপনের সম্ভাবনা বাড়ায় এবং এইচআইভি থেকে এডস-এ পরিণত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
- প্রতিদিন নিয়মিত ওষুধ সেবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওষুধ বন্ধ করে দিলে ভাইরাস দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
২. চিকিৎসা সঙ্গীর জন্য পরামর্শ:
এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির যৌনসঙ্গী বা সঙ্গিনীকেও পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
৩. প্রি-এক্সপোজার প্রফিল্যাক্সিস (PrEP):
যারা এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন, তারা PrEP ওষুধ সেবন করতে পারেন। PrEP নিয়মিত সেবন করলে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
৪. পোস্ট-এক্সপোজার প্রফিল্যাক্সিস (PEP):
যদি কেউ এইচআইভি সংক্রমণের সম্ভাব্য ঝুঁকিতে পড়েন, তবে সংক্রমণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে PEP চিকিৎসা শুরু করলে সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায়।
এইচআইভি প্রতিরোধের উপায়
এইচআইভি প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ মেনে চলা উচিত:
- নিরাপদ যৌনমিলন: কনডম ব্যবহার করলে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়।
- রক্ত পরীক্ষিত করার বিষয় নিশ্চিত করা: রক্ত গ্রহণ করার সময় এটি সংক্রমণমুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করা জরুরি।
- ইনজেকশন সরঞ্জাম ভাগাভাগি না করা: মাদকাসক্তি বা চিকিৎসার সময় ব্যবহৃত সূঁচ ও সিরিঞ্জ আলাদা রাখা উচিত।
- PrEP ও PEP: এইচআইভি প্রতিরোধে PrEP এবং PEP অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি।
এইচআইভি একটি গুরুতর যৌনবাহিত রোগ, তবে সঠিক সময়ে সনাক্তকরণ এবং অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এইচআইভি সংক্রমণ এড়ানোর জন্য নিরাপদ যৌনমিলন এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। যারা এইচআইভি সংক্রমিত, তাদের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনযাপন করতে পারেন।
আরো পড়ুন :
অকাল বীর্যপাত: কারণ, উপসর্গ ও সমাধান
যৌন সমস্যার উপসর্গ এবং কারণ: জানতে হবে সঠিক সমাধানের জন্য
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন : https://www.youtube.com/@ladduesnutrition